বিশ্বের ভয়ঙ্কর ৫ হ্যাকারের পরিচয়।
হ্যাকারদের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি বাড়ে ইন্টারনেট আবিষ্কার এবং সম্প্রসারণের পর থেকে। ইন্টারনেটকে সকলের জন্য উন্মুক্ত রাখার উদ্যোগ হিসেবেই প্রথমযুগের হ্যাকাররা তৎপর ছিলেন।
ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর সংযুক্ত বিশ্বে হ্যাকিং এক বড় হুমকির নাম। প্রতিবছর বিশ্বের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো হ্যাকিংয়ের শিকার হয়ে লাখ লাখ ডলার লোকসান দেয়। আবার হ্যাকার ঠেকাতে সাইবার নিরাপত্তার পিছনেও ব্যয় করতে হয় প্রচুর অর্থ।
হ্যাকারদের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি বাড়ে ইন্টারনেট আবিষ্কার এবং সম্প্রসারণের পর থেকে। অনলাইনে এখন নবীন হ্যাকাররা কার্যকর হ্যাকিং টুল প্রায়ই বিনামূল্যে ডাউনলোড করার সুযোগ পাচ্ছেন।
হ্যাকিংয়ের এই প্রবণতা অবশ্য একদিনে তৈরি হয়নি। অধুনা অপেশাদার হ্যাকারদের একটি বড় অংশ তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার সঙ্গে লিপ্ত। এরা মূলত সবার জন্য উন্মুক্ত এক ইন্টারনেট বিশ্ব ব্যবস্থায় বিশ্বাস রাখেন। তবে ইন্টারনেটকে সকলের জন্য উন্মুক্ত রাখার চেষ্টা কিন্তু প্রথমযুগের হ্যাকাররাই করেছিলেন।
আজকের দুনিয়ায় খুবই বিখ্যাত এসব হ্যাকার ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ কিছু ত্রুটি আবিষ্কার করেন। তাদের মাঝে শীর্ষ পাঁচজনের নাম প্রকাশ করেছে বিখ্যাত অ্যান্টি-ভাইরাস ও ইন্টারনেট সিক্যিউরিটি সফটওয়্যার সেবাদাতা ক্যাসপারেস্কি ল্যাব।
১. কেভিন মিটনিক
মার্কিন হ্যাকারদের মাঝে সবচেয়ে খ্যাতনামা কেভিন মিটনিক কিশোর বয়স থেকেই হ্যাকিংয়ে হাতযশ তৈরি করেছিলেন। ১৯৮১ সালে তিনি প্রথম প্যাসিফিক বেল নামক একটি টেলিফোন কোম্পানির কম্পিউটার ম্যানুয়াল চুরি করেন। তার পরের বছর ঘটান আরও দুঃসাহসী এক কাণ্ড।
কেভিন মিটনিক |
১৯৮২ সালে তিনি হ্যাক করেন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নোরাডের নেটওয়ার্ক। উল্লেখ্য, স্নায়ুযুদ্ধের সেই উত্তাল সময়ে সোভিয়েত পরমাণু হুমকি থেকে সতর্ক থাকতেই নোরাড তাদের সংযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। মিটনিকের এই হ্যাকিংয়ের ঘটনা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ সালে মুক্তি পায় ‘ওয়ার গেমস’ নামক এক চলচ্চিত্র।
সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুসারে মিটনিক বর্তমানে সফটওয়্যারের দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে সক্ষম বিশেষ প্যাচ অনলাইন নিলামে বিক্রি করছেন।
২. অ্যানোনিমাস
‘অ্যানোনিমাস’ শব্দের অর্থ অজ্ঞাতনামা। আর এই নামেই ২০০৩ সাল থেকে কাজ করছে হ্যাকারদের ছোট্ট এক গ্রুপ। হ্যাকার গোষ্ঠীটি সামাজিক বিচার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী। এই লক্ষ্য থেকেই তারা ২০০৮ সালে চার্চ অব সাইন্টোলজি নামে অভিজাত কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের এক ধর্মীয় গ্রুপের নেটওয়ার্ক হ্যাক করে।
অ্যানোনিমাস গ্রুপের প্রতীক |
অ্যানোনিমাস হ্যাকাররা ধর্মীয় গোষ্ঠীটির ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ করে দেয়। ফলে গুগল সার্চ র্যাংকিংয়ে কমে যায় এসব ওয়েবসাইটের র্যাংকিং। এখানেই শেষ নয়, ওই বছরের মার্চে এখন প্রায় সকলের পরিচিত গাই ফক্স মুখোশ পরে পুরো বিশ্বব্যাপী সাইন্টোলজির কেন্দ্রগুলো ভ্রমণ করে একদল ‘অ্যানো’।
নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিন জানায়, এফবিআই এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অ্যানোনিমাস দলের কয়েকজন সদস্যকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। তবে এরপরেও নেতৃত্ব কাঠামোয় সমতা থাকায় অ্যানোনিমাস’কে মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব।
৩. অ্যাড্রিয়ান লামো
২০ বছর বয়সী এই হ্যাকারের সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটান ২০০১ সালে । ওই বছর ইয়াহু’র একটি কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট টুল ব্যবহার করে তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক সংবাদে সম্পাদনা করেন। সংবাদে জুড়ে দেন, তৎকালীন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল জন অ্যাশক্রফটের এক কাল্পনিক বিবৃতি।
অ্যাড্রিয়ান লামো |
প্রত্যেক হ্যাকারের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। লামোর বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি হ্যাকিংয়ের পরেই তার ভিকটিম এবং গণমাধ্যম উভয়ের কাছেই তা প্রকাশ করে দিতেন।
দ্য ওয়্যারড জানায়, ২০০২ সালে লামো একটু বেশি সাহসী হয়ে ওঠেন। এসময় তিনি নিউইয়র্ক টাইমসের দাপ্তরিক নেটওয়ার্কে অনুপ্রবেশ করে, সেখানে নিজেকে একজন বিশেষজ্ঞ পরামর্শদাতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। টাইমসের ডাটাবেজ ব্যবহার করে কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের ওপর অনুসন্ধান শুরু করেন।
ব্যক্তি জীবনে আড্রিয়ান লামো যাযাবর প্রকৃতির। তার পুরো সংসার এক ব্যাকপ্যাকেই সীমাবদ্ধ। একারণেই গণমাধ্যমের কাছে দ্য হোমলেস হ্যাকার নামেই পরিচিত লামো। ২০১৮ সালে লামো মাত্র ৩৭ বছর বয়েসে মারা যান। তার আকস্মিক মৃত্যুর কোনো যথার্থ কারণ আজও উদঘাটণ করা সম্ভব হয়নি।
৪.অ্যালবার্ট গঞ্জালেজ
নিউইয়র্ক ডেইলির এক সংবাদে গঞ্জালেজের নাম দেওয়া হয়েছিলে ‘সুপানাজি’। সেদিন থেকে ওই নামেই তাকে চেনে হ্যাকিং দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ। মিয়ামির একটি হাইস্কুলে পড়ার সময়েই কম্পিউটার পোগ্রামিং আসক্ত কিশোরদের নিয়ে এক দল গড়ে তুলেছিনে গঞ্জালেজ। সেখান থেকেই তার পদস্খলন হয় একজন কুখ্যাত সাইবার অপরাধী হিসেবে।
অ্যালবার্ট গঞ্জালেজ |
সাইবার অপরাধীদের বাণিজ্যিক সাইট শ্যাডোক্রু ডটকমের একজন রীতিমতো সক্রিয় হয়ে ওঠেন গঞ্জালেজ। ওই সময়ে তাকে বাণিজ্যিক ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ে পৃথিবী সেরা হ্যাকার বলে গণ্য করা হতো। ২২ বছর বয়সে গঞ্জালেজকে প্রায় ১০ লাখ ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরির দায়ে নিউইয়র্কে গ্রেফতার করা হয়। এরপর কারাদণ্ড এড়াতে তিনি মার্কিন সরকারের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা সিক্রেট সার্ভিসের জন্য একজন তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করতে থাকেন।
তবে সাইবার অপরাধীদের লাগাম দেওয়া মুশকিল। সিক্রেট সার্ভিসের বেতনভোগী ইনফরমার হিসেবে কাজ করার সময়ে গঞ্জালেজ এবং তার সহযোগীরা মোট ১৮ কোটি ক্রেডিট কার্ড অ্যাকাউণ্টের তথ্য চুরি করে। এসময় টিজিএক্স নামক একটি ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি থেকে মোট ২৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার চুরি করা হয়। ২০১৫ সালে এসব অপরাধে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফেডারেল কোর্ট তাকে কারাদণ্ড দেয়।
৫.ম্যাথিউ বেভান ও রিচার্ড প্রাইস
১৯৯৬ সালে এই দুই ব্রিটিশ হ্যাক করেন বিশ্বের সুরক্ষিত কিছু সামরিক নেটওয়ার্ক। যেসব স্থাপনার নেটওয়ার্কে তারা অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হন এর মাঝে ছিল গ্রিফিজ বিমানঘাঁটি, ডিফেন্স ইনফরমেশন সিস্টেম এজেন্সি এবং কোরিয়ান অ্যাটমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউড (কারি)।
ম্যাথিউ বেভান ও রিচার্ড প্রাইস |
ডাটা স্ট্রিম কাউবয় খ্যাত এই দুই হ্যাকার তাদের নিজেদের কর্মকাণ্ডে বিশ্বকে প্রায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র গবেষণা তথ্য তারা মার্কিন সামরিক নেটওয়ার্কে ডাম্প করলে, এই হুমকি তৈরি হয়।